(১৯৭৪সালে প্রকাশিত বিদ্যালয় বার্ষিকী ‘কাকলী’ থেকে মুদ্রিত)
আজ থেকে ৬০ বছর আগে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে খুলনাঞ্চল ছিলো উন্নয়ন বঞ্চিত। এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো খুবই অবহেলিত। স্কুল-কলেজের সংখ্যা ছিলো অপ্রতুল। খুলনা শহরে মাত্র গোনা দু-তিনটি স্কুল ছিলো। ইংরেজি মাধ্যমে কোনো স্কুল ছিলো না।
খুলনা লায়ন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে এই ক্লাবের আন্তরিক প্রচেষ্টায় খুলনা লায়ন্স স্কুলের যাত্রা শুরু। লায়ন এস এম জুনায়েদ, লায়ন মাইকেল সুশীল অধিকারী, এ. এ. এন আলম-সহ বেশ কয়েকজন বিদ্যোৎসাহী লায়ন সদস্যদের নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৬৩ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি খুলনা শহরের অনতিদূরে গল্লামারী নামক স্থানে খুব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে দুই একর ৯২ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়। ওই সময়ে ক্রয়কৃত জমির সিংহভাগ অর্থ দিয়েছিলেন লায়ন মি. জুনায়েদ। পরবর্তীতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের বাবা (খুলনার দোলখোলা নিবাসী)’র কাছ থেকে দুই দফায় আরো ২৫ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়েছিলো।
এর আগে মিসেস ফোর্ড নামে একজন নারী তখন হরিদাস বাবু রোড (বর্তমান শের-এ বাংলা সড়ক) একটি প্রাইভেট ডে-স্কুল পরিচালনা করতেন। বিভিন্ন কারণে তিনি স্কুলটি চালাতে পারছিলেন না। তখন খুলনা লায়ন্স ক্লাব মাত্র তিন হাজার টাকায় তার কাছ থেকে স্কুলটি কিনে নেয়।
খুলনা লায়ন্স ক্লাব ১৯৬২ সালে একই স্থানে জুনিয়র ক্যামব্রিজ সিস্টেমে নতুনস্কুল চালু করে। স্কুলের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন তৎকালীন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ এম গিলবার্ট। মাত্র ৭২ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে একই বছর স্কুলের যাত্রা হয়।
গল্লামারীতে জায়গা কেনার পরপরই শুরু হলো স্কুল নির্মাণ কাজ। সাত লক্ষ ইট দান করে সেদিন স্কুল নির্মাণের যাত্রাকে সুগম করেছিলেন প্রয়াত জনাব সিরাজুল ইসলাস খাঁন ওরফে নসু খাঁন। তখন খুলনার ফুলবাড়িগেটে ছিলো নসু খাঁনের ইটের ভাটা। অন্যান্য লায়ন্স সদস্যরা বালি ও সিমেন্ট দিয়ে স্কুলটি নির্মাণে সহযোগিতা করলেন।
গল্লামারীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার নামকরণ করা হয়েছিলো ‘‘লায়ন্স ইংলিশ স্কুল’’। অত্যন্ত আধুনিক স্থাপত্যকৌশলে নির্মিত স্কুলটি ঐ সময়ে খুলনা শহরের একটি আধুনিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্কুলের হলরুমটি এমনভাবে নির্মাাণ করা হয়েছিলো যে, একদিকে যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের সভা করা, বৃষ্টি হলে অ্যাসেম্বলি করতে পারা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করাসহ জিমনেসিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা যেত। আবার ঐ হলরুমে দাঁড়িরে স্কুলের লম্বা করিডোর দিয়ে প্রিন্সিপাল দু’ধারে ক্লাসগুলো দেখতে পারতেন।
১৯৬৫ সালে গল্লামারীতে নতুন স্কুল ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের সিএসপি এ. আর. চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন বাংলাদেশ লায়নিজমের প্রতিষ্ঠাতা লায়ন এম আর সিদ্দীকি, লায়ন এ এস ডেনী, লায়ন এস এম জুনায়েদ, লায়ন সিরাজুল ইসলাম, লায়ন এম জামান প্রমুখ।
তখন দূরদুরান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসতো। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে খুলনা লায়ন্স ইংলিশ স্কুলটি বাংলাদেশের মধ্যে একটি নামকরা ইংরেজি স্কুল হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। তখনকার স্কুলে প্রিন্সিপাল ছিলেন জনাব এস এ আলভি। শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিসেস কনি খান, বিদ্যুৎ কান্তি সরকার, মোহাম্মদ ফজলুর রহমান-সহ বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা শিক্ষকবৃন্দ। পরবর্তীতে আরো কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন, যাদের কথা না বললেই নয়, যেমন লিলি খান, যতিন বিশ্বাস, ইদ্রিস আলী, রওশন আলী, বাবু মহিতোষ দাস, সাত্তার স্যার প্রমুখ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে স্কুলটির উপর নেমে আসে এক চরম দুর্যোগ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্কুলটি দখল করে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প তৈরী করলো। এসময় স্কুলের জানালা-দরজার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর স্কুলটির পরিচালনার দায়িত্ব চলে গেলো স্থানীয় জনগণের হাতে। স্কুলটি একটি বিরাট অস্তিত্ব সংকটে পড়লো। শিক্ষক নেই, অর্থ নেই, যোগ্য পরিচালনা পর্ষদ নেই এবং খুলনা লায়ন্স ক্লাবটিও তখন ছত্রভঙ্গ।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে খুলনা লায়ন্স ক্লাব পুনর্গঠিত হয়। স্বাধীনতা উত্তর খুলনা লায়ন্স ক্লাবের সভাপতি হলেন লায়ন এ এ এন আলম। তিনি তখন লায়ন মাইকেল সুশীল অধিকারী, লায়ন কিসমতউল হাকীম, লায়ন গনি চৌধুরী, লায়ন শেখ রাজ্জাক আলী (প্রাক্তন স্পিকার), লায়ন এ্যাডভোকেট ময়ীন-উদ-দীন আহম্মেদ সবাইকে নিয়ে স্কুলটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেন। পরবর্তীতে প্রাক্তন স্পিকার লায়ন এ্যাডভোকেট শেখ রাজ্জাক আলী, লায়ন এ্যাড ময়ীন-উদ-দীন আহম্মেদকে সঙ্গে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন এবং ঐ মামলার রায়ের মাধ্যমে খুলনা লায়ন্স স্কুলের কর্তৃত্ব ফিরে পান। ঐ সময়ে লায়ন গভর্নর ছিলেন এ কে এম মোশারফ হোসেন। তিনি তখন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি স্কুলটি সংস্কারে ব্যাপক অর্থ সহযোহিতা করেছিলেন।
আরো একটি না বললেই নয়। স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক বাবু বিদ্যুৎ কান্তি সরকার এবং ইংরেজি শিক্ষক মোঃ ফজলুর রহমান স্বাধীনতার পর স্কুল পুনঃগঠনে ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করেন। জনাব মোঃ ফজলুর রহমান স্যার ছিলেন স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। বিদ্যুৎ কান্তি সরকার ছিলেন ছিলেন ইতিহাস ও ভুগোলের শিক্ষক।
যুদ্ধকালে ফজলুর রহমান স্যার স্কুলের আশেপাশে থেকে সর্বক্ষণ স্কুলের সমস্ত মালামালের দিকে নজর রাখতেন। বিদ্যুৎ কান্তি সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে ভারত থেকে ফিরে এসে স্কুলের ভগ্নদশা দেখে ব্যথিত হলেন এবং তিনি স্কুল পুনঃগঠনে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। খুলনা লায়ন্স ক্লাব এবং প্রাক্তন কয়েকজন শিক্ষকের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় স্কুলটি প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করলো। যোগাযোগ শুরু হলো বিভিন্ন অর্থ সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তখন বোম্বে লায়ন্স ক্লাবে এবং বোম্বের একটি দাতা সংস্থা ‘‘সঞ্জিবনী ট্রাস্ট’’-এর সদস্যরা লায়ন্স স্কুল পরিদর্শন করেন এবং স্কুলটি পুনঃনির্মাণে অর্থ সহযোগিতা করেন।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের এক বিজ্ঞপ্তিতে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি বাতিল ঘোষণা করে বাংলাকে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম করার ঘোষণা দেয়া হয়। ঐ ঘোষণার ফলে ‘লায়ন্স ইংলিশ স্কুল’ হয়ে গেলো ‘লায়ন্স স্কুল’। ১৯৭৩ সালে সর্বশেষ এই স্কুল থেকে ইংরেজি মিডিয়ামে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিয়েছিলো। খুলনা লায়ন্স স্কুলে প্রথম থেকেই কো-এডুকেশন সিস্টেম চালু ছিলো অর্থাৎ ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়তো। সেই ধারাটি এখনো বিদ্যমান আছে।
১৯৮৬ সালে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হয়। বর্তমানে খুলনা লায়ন্স ক্লাব স্কুলের দাতা ও বিদোৎসাহী সদস্য হিসেবে স্কুলকে সহযোগিতা করে আসছেন। ২০১৯ সালে অনুদানে লায়ন্স স্কুলে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য, বর্তমানে স্কুলটি সেই অতীত গৌরবকে হারিয়েছে। আমরা যারা প্রাক্তন ছাত্র/ছাত্রী আছি, আমাদের উচিৎ স্কুলের উন্নয়নে আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে আসা। কারণ এই স্কুলের সঙ্গে আমাদের সুনাম নির্ভরশীল।
পরিশেষে বলা যায়, খুলনায় গল্লামারী অঞ্চলে একটি সরকারি স্কুল নেই। এই অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের সেই দূরে গিয়ে জিলা, করোনেশন, কিংবা অধুনা মডেল ও ইকবাল নগর স্কুলে যেতে হয়। আমি আশা করি, এ অঞ্চলে শিক্ষার মান উন্নয়নে খুলনা লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ সরকারিকরণ এখন সময়ের দাবী।
বাদশা খান